Court Room

অন্যজনকে ফাসিয়ে মূল আসামী বিদেশ

13 September 2020

১। অত্র মামলার আসামী X দেশের অন্যতম স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এবতেদায়ী শাখার ভাইস প্রিন্সিপাল। তিনি জীবনে কোনদিন কোন মামলার আসামী ছিলেন না। জেলেও যাননি। তথাপি খিলগাঁও থানার একটি মামলায় দন্ডবিধির ধারা- ১৪৩ ও ৪৪৫ ধারায় তাকে আসামী করা হয়। বিজ্ঞ অতিঃ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ঢাকা ১১ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা ইস্যু করেন। পুলিশ গ্রেফতার করার জন্য তার গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালায়। তিনি তখন ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। সংবাদ পেয়ে তিনি হতঃবিহ্বল হয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে আমার মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন। আমি কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলি।

২। নথি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ৯ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে অভিযোগকারীর বাস সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ভাড়ায় চালাচ্ছিল। হরতাল চলা অবস্থায় জামাত-শিবির ও বি এন পি দলীয় নেতা কর্মীরা তার এ বাসে আক্রমণ চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ করে, এই মর্মে তিনি খিলগাঁও থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। উক্ত অভিযোগে কোন আসামীর নাম উল্লেখ ছিলনা। নিম্নে অভিযোগের প্রাসঙ্গিক অংশ তুলে ধরা হলঃ

“অদ্য ইং ০৯/০৪/২০১৩ তারিখ ভোর অনুমান ০৫.৩০ ঘটিকার সময় জামাত-শিবির ও বিএনপির ১৮ দলীয় আহুত হরতালের শ্লোগ্রান দিয়া অবৈধ জনতাবদ্ধে দলবদ্ধ হইয়া অজ্ঞাতনামা ২৫/৩০ জন হঠাৎ অতর্কীতভাবে মারমুখী হইয়া আসিয়া লাঠি সোটা ও ইট দিয়া আমার উক্ত গাড়ির গ্লাস ও বড়িতে পিটাইয়া গ্লাস ভাঙ্গিয়া ফেলে ও গাড়ির ক্ষতি সাধন করে। যাহার ক্ষতির পরিমাণ অনুমান ১০০০০০ (এক লক্ষ) টাকা। উক্ত গাড়িতে থাকা ড্রাইভার ও হেলপারদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে গাড়ীতে পেট্রোল ও দাহ্য পদার্থ ঢালিয়া অগ্নি সংযোগ করে। গাড়িতে ঘুমন্ত থাকা ড্রাইভার ও হেলপার জানালা দিয়া লাফাইয়া প্রাণে রক্ষা পায়। অগ্নি সংযোগের ফলে গাড়ির সম্পূর্ণ সিট ও অন্যান্য ডেকোরেশনসহ আনুসঙ্গিক কাগজপত্র আগুনে পুড়িয়া অনুমান ৩০০০০০ (তিন লক্ষ) টাকার ক্ষতি সাধন হয়। উক্ত গাড়ির ড্রাইভার, হেলপার ও আশপাশের লোকজনদের নিকট শুনিয়া অভিযোগ দায়ের করিতে বিলম্ব হইল।”

৩। বিগত ০৯ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে খিলগাঁও থানার এস আই একটি জব্দ তালিকা প্রস্তুত করেন। উক্ত জব্দ তালিকার প্রয়োজনীয় অংশ নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

“একটি অগ্নিদগ্ধ বায়ান্নো আসন বিশিষ্ট যাত্রীবাহী পুরাতন বাস, যাহার সামনে ও পিছনের গ্লাসসসহ জানালার সবকয়টি আগুনে পোড়ানো সকল বসিবার আসনগুলো অগ্নিদগ্ধ, বাসটি ছাদ থেকে বডি অর্ধেক অংশ অগ্নিদগ্ধ হইয়াছে।”

৪। উল্লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ২২ অক্টোবর ২০১৩ ইং তারিখে ৩ জনকে সন্দিগ্ধ আসামী হিসাবে গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর তাদেরকে বিজ্ঞ মূখ্য মহানগর হাকীম আদালত, ঢাকা-এর বরাবরে প্রেরণ করেন এবং ৭ দিনের পুলিশ বিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করেন। উক্ত Forwarding এ ৩ নং আসামী হিসেবে X এর নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়। প্রয়োজনীয় অংশ নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

“(৩) মোঃ X (৩২), পিতা- Y, মাতা- Z,…….. থানা- কোম্পানীগঞ্জ, জেলা- নোয়াখালী।”

৫। অতঃপর ৩১ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে বিজ্ঞ অতিঃ চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নং- ০৪, ঢাকা তিন জন আসামীর জামিন মঞ্জুর করেন। উক্ত আদেশের প্রয়োজনীয় অংশ নিম্নে তুলে ধরা হলঃ

“দেখিলাম। উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনিলাম। নথিসহ দরখাস্ত পর্যালোচনা করিলাম। সহ আসামী জামিনে আছে। সন্দেহে ধৃত। দীর্ঘদিন হাজৎবাস। সার্বিক বিবেচনায় আসামী প্রত্যেককে সহ আসামীর সম-শর্তে জামিন মঞ্জুর করা হল।”

৬। অতঃপর ৮ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে খিলগাঁও থানার এসআই তদন্তকারী অফিসার হিসাবে দন্ডবিধির ১৪৩/৩০৭/৪২৭/৪৩৬ ধারায় অভিযোগ পত্র দায়ের করেন। উক্ত অভিযোগ পত্রে ৭ জন আসামীর নাম উল্লেখ করা হয়। X এর ক্রমিক নং-৭। নিম্নে প্রয়োজনীয় অংশ উল্লেখ করা হলঃ

“(7) মোঃ X (৩২), পিতা- Y, মাতা- Z,…….. থানা- কোম্পানীগঞ্জ, জেলা- নোয়াখালী।”

৭। এই অভিযোগ পত্রের ভিত্তিতে ১১ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে বিজ্ঞ ৩য় অতিঃ চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নং- ৪, ঢাকা অত্র ৭ জন আসামীর বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ১৪৩/৪৩৫ ধারায় অভিযোগ গঠন করেন এবং গর হাজির থাকায় মোহাম্মদ X ও আরেকজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। নিম্নে প্রয়োজনীয় অংশ উল্লেখ করা হলঃ

“বিজ্ঞ কৌসূলী সময়ের দরখাস্ত দাখিল করেন। শুনানির জন্য নথি পেশ করা হইল। বিজ্ঞ কৌসূলীগণকে শুনলাম। অদ্য আসামী….দ্বয়ের সময়ের আবেদন না মঞ্জুর করা হইল। তাদের জামিন বাতিল করা হইল। তাদের বিরুদ্ধে W/A ইস্যু করা হোক। ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৩৯বি (১)(২) ধারা মোতাবেক তাদের বিচার অনুপস্থিতিতে চলবে।”

আজ পর্যন্ত অত্র মামলার কোন সাক্ষী গৃহীত হয় নাই।

৮। এই গ্রেফতারি পরোয়ানামূলে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করার জন্য বারবার প্রচেষ্ট চালায়। তিনি কর্মস্থলে থাকায় তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এই সংবাদ পেয়ে তিনি নিম্ন আদালতের সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন তোলেন যে, “আমি তো কোনদিন জেলে যাই নি। আমার বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই। তাহলে আদালত আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেন কেন?” নিম্ন আদালতের সংশ্লিষ্ট আইনজীবী তাকে আত্ম সমর্পন করে জামিন নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি এ পরামর্শ গ্রহণ করেননি। এই পরিস্থিতিতে তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করেন। আমি তাকে পরামর্শ দেই যে, যদি ঘটনা সত্য হয়ে থাকে তাহলে তিনি সরাসরি হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করতে পারেন। তিনি আমার পরামর্শ গ্রহণ করেন। আমি তাকে সংশ্লিষ্ট সকল কাগজ পত্রের সার্টিফাইড কপি ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দিই। তিনি এই মামলা সংক্রান্তে জেলে থাকা প্রকৃত ব্যক্তির ন্যাশনাল আইডি কার্ড, নিম্ন আদালতের জামিন নামার কপিসহ যাবতীয় কাগজপত্র আমার চেম্বারে নিয়ে আসেন। আমার জুনিয়র এডভোকেট সাদ্দাম হোসেন কে কাগজ পত্র পর্যালোচনা করার দায়িত্ব দেই। সকল কাগজ পর্যালোচনা করে জানান যে, প্রকৃত কোন ব্যক্তি জেলে ছিল তা আমরা কেমনে বুঝব? এই ঘটনার সুনির্দিষ্ট তথ্য দরকার। আমরা তথ্য অধিকার আইনের অধীন সিনিয়র জেল সুপার, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ বরাবর ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০ তারিখে সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে একটি আবেদন দায়ের করি। উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে ০৪ মার্চ ২০২০ তারিখে সিনিয়র জেল সুপার, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ পত্র মারফতে হাজতে বন্দী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেন। একই সাথে কারাগারের রক্ষিত সংশ্লিষ্ট আসামীর ছবি সংবলিত রেকর্ডের সত্যয়িত ফটোকপি প্রদান করেন। উক্ত কপিতে মামলার নং, ঠিকানা, উচ্চতা, গায়ের রং, শরীরের বিশেষ চিহ্নসহ বিস্তারিত উল্লেখ আছে।

৯। এই তথ্য পাওয়ার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, জনাব X এর বিরুদ্ধে প্রেরিত গ্রেফতারি পরোয়ানাকে চ্যালেঞ্জ করে রিট পিটিশন দায়ের করব। সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করি। লিগ্যাল রিসার্স করি এবং কয়েকটি নজীর সংগ্রহ করি। রিট পিটিশন ড্রাফট করে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে এফিডেভিট সম্পন্ন করি। পরের দিন মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে। শুনানিতে আমি বিস্তারিত তুলে ধরি। আমার কথা শোনার পর মাননীয় বিচারপতি জনাব এম এনায়েতুর রহীম ও মোস্তাফিজুর রহমান বিস্ময় প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জনাব এম.এম.জি. সারোয়ার (পায়েল) বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তার বক্তব্যের মূল কথা ছিল “এই ক্ষেত্রে রিট মামলা Maintainable নয়। গ্রেফতারি পরোয়ানা চ্যালেঞ্জ করে রিট পিটিশন করা যায় না। নিম্নে আদালতে আত্মসমর্পন করাই তার একমাত্র পথ। সুতরাং এই রিট মামলাটি খারিজ যোগ্য।” তাঁর এই যুক্তি তর্কের প্রেক্ষিতে আদালত আমাকে প্রশ্ন করলে আমি নিম্নোক্ত উত্তর দেইঃ

“My Lords, perhaps I could not make my learned friend understand that the instant writ petitioner is not the accused in relation to the impugned criminal proceeding. He is not the accused in this case. He was never arrested and put to the custody in relation to any case whatsoever. He is not an absconding person. Therefore, there is no question of surrender comes. He does not have equally efficacious alternative remedy. Writ jurisdiction is his only remedy. In support of my argument, I heavily relied on the decisions of Abul Khair and Others vs. DC, Thakurgaon and Others, reported in 15 BLC 439; Bangladesh Jatiyo Mahila Ainjibi Samity vs. Government of the People’s Republic of Bangladesh, reported in 14 BLC 11; Rezaul Karim vs. State and Others, reported in 5 ADC 266 and Md. Matin Mia vs. Government of Bangladesh and Others, reported in 13 BLT 328 and submitted that in this peculiar circumstances earlier our superior Court exercised its original jurisdiction and your Lordships holds sufficient constitutional power to interfere in this matter.”

এই যুক্তি তর্ক শেষে মাননীয় আদালত আদেশের জন্য পরের দিন ধার্য করেন।

১০। ১০ মার্চ ২০২০ তারিখে আদালত সন্তুষ্ট হয়ে রুল জারি করেন এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা স্থগিত করেন এবং পিবিআই কে তদন্ত করে সঠিক ব্যক্তি নির্ধারণের আদেশ দেন। নিম্নে আদেশের সংশ্লিষ্ট অংশ তুলে ধরা হলঃ

“Let Rule Nisi be issued calling upon the Respondents to show cause as to why the actions of the Respondents implicating the Petitioner with the Khilgaon police Station Case No.…under section 143 and 435 of the Penal Code and the Order No…passed by the learned Additional Chief Metropolitan Magistrate, Dhaka in the said case so far as relates to issuing warrant of arrest against the Petitioner should not be declared without lawful authority and is of no legal effect and/or pass such other or further order or orders as to this Court may deem fit and proper.

Pending hearing of the Rule, let the operation of the enforcement of the Order dated… so far as it relates to the arrest warrant against the Petitioner in connection with Khilgaon police Station Case No…passed by the learned Additional Chief Metropolitan Magistrate, Dhaka be stayed for a period of two months from date.

The Police Bureau of Investigation (PBI) is directed to conduct an inquiry in order to ascertain the identity of the person who was in custody in connection with aforesaid case and submit a report to this Court within the said period of two months.”

এই আদেশের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ মাননীয় চেম্বার বিচারপতির আদালতে আপীল দায়ের করেন। উক্ত আপীল মামলাটি বর্তমান পরিস্থিতির কারণে শুনানি হয়নি।

signature
13 September 2020