Court Room

আশুলিয়া ব্যাংক ডাকাতি ও এক নিরপরাধ বাবুল সরদার

13 September 2020

১। ২২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে আশুলিয়া থানাধীন কাঠগড়া বাজারস্থ বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড এর শাখায় হত্যা ও ডাকাতি সংঘটিত হয়। এই ঘটনায় দুজনের নাম উল্লেখপূর্বক ৮/১০ জনকে আসামী করে দন্ডবিধির ৩৯৬/৪১২ তৎসহ বিস্ফোরক উপাদানবলী আইন, ১৯০৮ এর ধারা ৩/৪ এ মামলা দায়ের হয়। অত্র মামলায় বাবুল সরদারের নাম আসামীর তালিকায় ছিল না। অতঃপর ১ লা ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে মামলার অভিযোগ পত্র দেয়া হয়। উক্ত অভিযোগ পত্রে বাবুল সরদারকে ৩ নং আসামী হিসাবে দেখানো হয়। আইন অনুযায়ী একই এজাহার থেকে দন্ডবিধি ও বিস্ফোরক উপাদানাবলী আইনের অধীন দুটি ভিন্ন আদালতে বিচার শুরু হয়। ৩১ মে ২০১৬ তারিখে ২০১৬ তারিখে দন্ড বিধির অধীন মামলার রায় ঘোষিত হয়। উক্ত রায়ে ৬ জনকে ফাঁসি, ১ জনকে যাবজ্জীবন, ২ জনকে ৩ বছরের কারাদন্ড এবং ২ জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। খালাসপ্রাপ্ত দুজনের একজন হলে বাবুল সরদার। কিন্তু বিস্ফোরক উপাদানবলী আইনের বিচার এখনও চলমান। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, ৬ষ্ঠ আদালত, ঢাকায় মামলাটি বিচারাধীন। ৩ রা জুলাই ২০১৮ তারিখে উক্ত আদালতে বাবুল সরদারের জামিন আবেদন করা হয় এবং জামিন না-মঞ্জুর হয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ১২ জুলাই ২০১৮ তারিখে আপীল দায়ের করি। আপীল এডমিশনের জন্য এনেক্স-৮ নং কোর্টে শুনানি করলে মাননীয় বিচারপতি এই পর্যায়ে জামিন না দিয়ে আপীল এডমিট করে পূর্ণাঙ্গ শুনানির নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ শুনানির পর মাননীয় আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন।

২। ২২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড, কাঠগড়া বাজার শাখা, আশুলিয়াতে ভয়ঙ্কর ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ


২২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড এর জনৈক কর্মকর্তা আশুলিয়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেন যে, ২১ এপ্রিল ২০১৫ তারিখ সকাল ০৯.৩০ ঘটিকায় আমার কর্মস্থলে পৌছে নিজ কাজে কর্মরত থাকি। বেলা আনুমানিক ০২.৩০ ঘটিকার সময় ৮/১০ জনের একটি সশস্ত্র ডাকাত দল ব্যাংকে প্রবেশ করে অতর্কিতভাবে দুজন নিরাপত্তাকর্মীকে ছুরিকাঘাত করে ও উপস্থিত সকলকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। তারা ব্যাংকের অভ্যন্তরে থাকা লোকজনকে গুলি করে ভয় দেখিয়ে ক্যাশ কাউন্টার থেকে নগদ ৬৮৭১৯৩/- টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় ব্যাংকের ম্যানেজারসহ কয়েকজনকে হত্যা ও গুরুতর জখম করে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় তারা ছুরিকাঘাত ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।

ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা মসজিদের মাইকে প্রচারিত হলে স্থানীয় জনতা ও পুলিশ সংঘবদ্ধভাবে দুইজন ডাকাতকে আটক করে। তন্মেধ্যে একজন ডাকাত গণপিটুনির শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এ সময় পুলিশ ধৃত ডাকাতদ্বয়ের নিকট হতে নগদ ৬০৭২৫৫/- টাকা, ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল ও একটি রক্তমাখা চাকু উদ্ধার করে।


২৫ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে উক্ত ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় মোঃ বাবুল সরদারকে সন্দেহমূলকভাবে প্রেফতার পূর্বক বিজ্ঞ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা এর আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। সার্বিক বিবেচনায় আদালত তিন দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ০৭ মে ২০১৫ তারিখে পুনরায় আসামীকে বিজ্ঞ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা এর আদালতে হাজির করে পুনরায় সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করলে বিজ্ঞ আদালাত আসামীকে পুনরায় এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে আসামীকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

৩। উক্ত ঘটনাটি দন্ড বিধির ধারা ৩৯৬/৪১২ তৎসহ বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনের ধারা ৩/৪ মোতাবেক আশুলিয়া থানার মামলা নং-৩৫ (৪)২০১৫ ইং রুজু করা হয়। পুলিশ তদন্ত শেষে দন্ড বিধি ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনের অধীনে ৮ (আট) জনকে আসামী করে দুটি পৃথক অভিযোগপত্র দাখিল করে। আসামী বাবুল সরদারকে দুটি অভিযোগপত্রতেই আসামী হিসাবে দেখানো হয়। অভিযোগপত্র নং- ৩৪২, ধারাঃ ৩৯৬/২১২ দঃ বিধি টি বিজ্ঞ দায়রা জজ, ঢাকা এর আদালতে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।


৪। উক্ত মামলায় মোট ১১ জন আসামীর বিচার করা হয়। দীর্ঘ এক বছর একমাস দশ দিন যাবৎ মোট ৬৪ জন সাক্ষীর সাক্ষের ভিত্তিতে ৩১ মে ২০১৬ তারিখে বিজ্ঞ দায়রা জজ, ঢাকা মামলাটির রায় প্রদান করেন। উক্ত রায়ে বিজ্ঞ আদালত ৬ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন, ১ জন কে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ২ জনকে ৩ বছরের কারাদন্ড প্রদান করেন। আসামী বাবুল সরদারসহ অন্য একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বিজ্ঞ আদালত তাদেরকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন।


৫। আলোচিত এই মামলার ৭ জন আসামী বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট স্বীকারোক্তি মূলক জবান বন্দী প্রদান করে তবে তাদের কেউই আসামী বাবুল সরদারের নাম উল্লেখ করেনি। বিচারিক আদালতে ৬৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২ জন সাক্ষী আসামী বাবুল সরদারের নাম উল্লেখ করলেও রাষ্ট্রপক্ষ সুনির্দিষ্টভাবে কোন অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। বিজ্ঞ প্রসিকিউটর খোলামেলাভবে সেটি স্বীকার করেন। উক্ত কারণে বিজ্ঞ আদালত আসামী বাবুল সরদারকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন। বিজ্ঞ আদালতের ভাষায় রায়ের সংশ্লিষ্ট অংশ নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

“As far as accused Babul Sarder is concerned the learned Public Prosecutor frankly conceded that the prosecution could not adduce any reliable evidence in support of the complicity of the accused in the commission of dacoity and murder in the Commerce Bank, Kathgora Branch on 21.04.2015 at 2.30pm… Accused Babul Sarder did not make any statement under section 164 of the Code of Criminal Procedure, 1898 before a Judicial Magistrate confessing his guilt. As many as 7 co-accused persons have made separate confessional statements under section 164 of the Code of Criminal Procedure, 1898 before a Judicial Magistrate which inculpatory in nature. But none of the above co-accused has mentioned the name of accused Babul Sarder as an accomplice. As such I must conclude that the prosecution has failed to substantiate the allegation leveled against accused Babul Sarder…”

৬। উল্লিখিত মামলায় আসামী বাবুল সরদার খালাস পেলেও একই ঘটনার পৃথক অভিযোগপত্রের অধীন বিজ্ঞ সিনিয়র স্পেশাল বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১৮, ঢাকা এর আদালতে বিচারাধীন মামলায় তিনি কারাগারে অন্তরীন ছিলেন। আসামী বাবুল সরদার বিজ্ঞ স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে জামিন আবেদন প্রার্থনা করলে বিজ্ঞ ট্রাইব্যুনাল ৩ জুলাই ২০১৮ তারিখের আদেশ বলে উক্ত আবেদন না মঞ্জুর করেন। ১২ জুলাই ২০১৮ তারিখে আসামী বাবুল সরদার উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে মহামন্য হাইকোর্ট বিভাগে একটি আপিল দায়ের করেন। ২৪ জুলাই ২০১৮ তারিখে শুনানিঅন্তে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ আপিল এডমিট করেন।

৭। আপীল শুনানির জন্য প্রস্তুত করে ২রা আগস্ট ২০১৮ তারিখে আদালতের সামনে হাজির করি। সেদিন থেকে প্রায় ১ বছর ২ মাস সময় ধরে এই জামিন আবেদনটি শুনানি হয়। অবশেষে ২০ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে বাবুল সরদারের জামিন মঞ্জুর হয়। ১৪ মাসের এই পথ চলায় নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে। কখনো আশা, কখনো নিরাশার এক দুলাচলবৃত্তি আমাকে ঘিরে ধরেছে। অন্ধকার এই পথ ভেদ করে অবশেষে বাবুল সরদারের ভাগ্যাকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসে উঠে। নিম্নে তার কিয়দংশ বর্ণনা করা হলঃ


৫ আগস্ট ২০১৮ তারিখে আমি আদালতের সামনে জামিন আবেদন উপস্থাপন করি। আমি বলি “My Lords, FIR was lodged under sections 396/412 of the Penal Code read with sections 3/4 of the Explosive Substances Act, 1908. After submission of Charge Sheet, two proceedings arose out of the same FIR. I have been acquitted by a competent Court in relation to the proceeding under Penal Code. Now I am facing trial under Explosive Substances Act. Out of 97 cited witnesses, only 20 have been examined and none of them mentioned my name with the alleged offence. Under these circumstances, there is a likelihood that the trial will not be concluded recently and I have been acquitted by a competent Court. Hence, I am entitled to be released on bail.” The Judges appear to be convinced and directed the prosecution to go through the papers submitted by me. The Government was taking time repeatedly. Finally, on 25th October 2018 they came with their submission. In the meantime, I collected the latest certified copies of the order of the Tribunal and showed that no further witness was examined. By this way, in total the matter was heard for 92 days.


In the meantime, I collected relevant documents time to time from the High Court Division and the lower Court. Once the Tadbirkar of the case became frustrated and informed me that he is not interested to proceed with the case. I called him to know the reason why he decided to do so? He answered ‘স্যার, আমার কোন সামর্থ্য নেই। আমি কাগজপত্র জোগাড় করতে পারব না।’ I became puzzled and instantly called my junior Asadullah and instructed him to collect 5 thousand taka from my clerk and give it to Tadbirkar for collection of documents. The Tadbirkar receiving that amount hurriedly called me back. He was crying and repeatedly saying, ‘Sir, sir, sir, sir, এইটা কি হইল?’ আমি বললাম, ‘টাকাটা নাও, জরুরি সার্টিফাইড কপি যোগাড় করে দাও। পরে দেখা যাবে কি হয়। আগে বেইল হোক।’


৮। ২০ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে বাবুল সরদারের জামিন হয়। ক্লার্ককে বললাম জরুরি কেভিয়েট দিতে। আমার জুনিয়র আসাদুল্লাহকে বললাম আদেশটা যেন দ্রুত নিম্ন আদালতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সে যথারীতি তাই করল। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে যোহরের নামাজের সময় একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক কোর্ট চেম্বারের সামনে আমাকে সালাম দিচ্ছিল। আমি তাকে চিনতে পারি নাই। কারণ আমি তাকে কোন দিন দেখি নাই। সে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘স্যার আমি বাবুল সরদার। আপনি না থাকলে আমি জীবনেও জেল থেকে বাইর হইতে পারতাম না। আমার চামড়া বেইচাও এই ঋণ শোধ করতে পারব না। আপনি নিজের পকেটের টাকা খরচ কইরা আমারে জেল থেকে বাইর করছেন। আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ আমার জন্য এইগুলা করে নাই।…’ বলতে বলতে তার চোখের পানি দাড়ি ভিজে গড়িয়ে পড়ছিল। আমি কিছুটা ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তাকে দুপুরের খাবারের দাওয়াত দেই। সে খেয়ে আমাকে সালাম বলে বিদায় নেয়। এই ঘটনা স্মৃতিতে অম্লান!!!

signature
13 September 2020