Court Room

উচু ও নিচু জাতের প্রেমের বিবাহঃ ১৪ বছরের সাজা

20 September 2020

১। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর আওতায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়। অত্র মামলায় মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ভিকটিমের বয়স নির্ধারণ ও আন্ত-বর্ণীয় বিবাহ (inter-caste marriage) এর বৈধতা। বিষয়টি ব্যতিক্রম হওয়ায় আদালত, উভয় পক্ষ ও নিযুক্তীয় আইনজীবীদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। উচ্চ বর্ণের সুষ্মিতা দেবনাথ হরিজন সম্প্রদায়ের তুষার দাসকে বিবাহ করে। তাদের কোলে একটি সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু সুষ্মিতার পরিবার এই বিয়ে মেনে নেয় নি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করে। মামলার পর তুষার দাসকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। সুষ্মিতা দেবনাথকে আদালতের আদেশে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে রাখা হয়। পরবর্তীতে শরীয়তপুর নারী ও শিশু আদালতের আদেশে তারা জামিন পায়। এই জামিন আদেশ মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগ স্থগিত করে দেন। ফলশ্রুতিতে তারা বেশ কিছু দিন পালিয়ে বেড়ায়। পরবর্তীতে হাইকোর্ট বিভাগ পূর্বের আদেশ সংশোধন করে জামিন বহাল রাখে। ইতোমধ্যে নিম্ন আদালত খুব দ্রুত মামলার বিচার সম্পন্ন করে তুষার দাসকে ১৪ বছরের কারাদন্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা প্রদান করে। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করি। মাননীয় আদালত তুষার দাসকে আপীল নিষ্পত্তির আগ পর্যন্ত জামিন প্রদান করেন।



২। মামলার নথিতে বর্ণিত ঘটনাটি নিম্নরূপঃ



ক। অভিযোগকারী এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেন যে, তার মেয়ে সুষ্মিতা দেবনাথ @ অদিতি (১৫) ১০ম শ্রেনীতে লেখাপড়া করে এবং ২০১৮ সালের এস এস সি পরীক্ষার্থী। স্কুলে যাওয়া আসার পথে আসামী তুষার দাস @ মেথর (২০) তার মেয়েকে নানা ধরনের কু-প্রস্তাব দিয়ে আসতেছিল। তার মেয়ে কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এবং বিষয়টি আসামীর পরিবারের লোকজনদের জানানোর কারণে আসামী তুষার দাসসহ নিম্নবর্ণিত আসামীগণ মনে মনে তার মেয়ের প্রতি ক্ষিপ্ত হইয়া থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৫ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে দুপুরবেলা টেস্ট পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তার মেয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে দুপুর অনুমান ১ টা ২০ ঘটিকার সময় রাস্তার উপর পৌছামাত্র পূর্ব হইতে ওঁত পেতে থাকা ১ নং আসামী তুষার দাস অপর আসামীদের সহযোগিতায় ও কু-পরামর্শে আমার নাবালিকা মেয়ে সুষ্মিতা দেবনাথ @ অদিতিকে ফুসলাইয়া ও বিবাহের প্রস্তাব দেওয়াসহ নানা ধরনের প্রলোভন দেখাইয়া জোর পূর্বক অপহরণ করিয়া অজ্ঞাত স্থানে নিয়া যায়।



খ। আসামী পক্ষরে ভাষ্যমতে, তাঁরা সুষ্মিতা দেবনাথ অদিতিকে স্কুলে যাওয়ার পথে জোরর্পূবক অপহরণ করে নাই বরং সে নিজেই পূর্ব-সম্পর্কের জের ধরে তুষার দাসকে ফোন করে বিবাহের উদ্দেশ্যে তার সাথে চলে যায়।



গ। ২৬ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে ভিকটিম সুষ্মিতা দেবনাথ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারা মোতাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দী প্রদান করে। উক্ত জবানবন্দী নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলঃ

“গত দুবছর যাবৎ ১ নং আসামী তুষার দাস এর সাথে প্রেমের সর্ম্পক ছিল। গত ১৫ অক্টোবর তারিখ দুপুর ১.৩০ ঘটিকায় আমি স্কুলে হল রুম হতে বের হয়ে রাস্তার একজন লোকের নিকট মোবাইল নিয়ে তুষারকে ফোন দেই। বলি যে আমারে নিয়ে যাও, না হলে আত্মহত্যা করব। আমার কথার ভিত্তিতে তুষার এসে কলেজের সামনে থেকে নিয়ে যায়। আমাদের সম্পর্ক বাবা জানত। ১৫ অক্টোবর ২০১৭ তারখি রাতে ঢাকা গিয়ে ঢাকশ্বেরী মন্দিরে আমরা বিয়ে করি। আমি স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছি। বিয়ের পর ১১ দিন সংসার করেছি।”

ঘ। ২৬ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে আসামী তুষার দাস ওরফে রাজকে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, শরীয়তপুর এর আদালতে হাজির করা হয়। বিজ্ঞ আদালত জামিন না মঞ্জুর করে তাকে হাজতে প্রেরণ করেন। মামলার ভিকটিম সুষ্মিতা দেবনাথকে সেইফ হাউজে প্রেরণ করেন।



ঙ। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে তদন্তকারী র্কমর্কতা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২১ মার্চ ২০১৮ তারিখে অভিযোগকারী তার মেয়েকে নিজ জিম্মায় নেয়ার জন্য আবেদন দায়ের করেন। ২ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে আসামী পক্ষ ভিকটিমের বয়স নির্ধারণের জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠনের প্রার্থনা করেন। বিজ্ঞ আদালত বয়স নির্ধারণের জন্য সিভিল র্সাজন, শরীয়তপুর কে মেডিকেল বোর্ড গঠনের নির্দেশ দেন। ১৪ মে ২০১৮ তারিখে মেডিকেল বোর্ড physical and radiological examination শেষে মতামত প্রদান করেন। মেডিকেল রিপোর্টের প্রাসঙ্গিক অংশ নিম্নে তুলে ধরা হলঃ

“According to physical and radiological examination, we undersigned opined that the victim is in between 18-19 (eighteen to nineteen) years of old at the time of examination.”

চ। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, শরীয়তপুর কিশোর মামলা নং- ৫/২০১৮ সংক্রান্তে নিম্নোক্ত আদেশ প্রদান করেনঃ



উভয় পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী, রাষ্ট্র পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী, এজাহারকারী, আইনজীবী সমিতি, শরীয়তপুরের বিজ্ঞ সভাপতি ও সেক্রেটারি, ভিকটিম সুষ্মিতা দেবনাথসহ প্রত্যেকের বক্তব্য শ্রবণ করলাম। প্রত্যকে মানুষের জন্যই তার নিজ নিজ ধর্ম অত্যন্ত সম্মানের ও প্রতিপালনীয়। আলোচ্য মামলায় এজাহারকারী, আসামী, ভিকটিম সকলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তবে তাদের মধ্যে জাত বিবেচনা করলে বিভেদ রয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণে দুজন মানুষের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে, তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন ব্যাহত হবে বিষয়টি কাম্য নয়। মূল মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এমতাবস্থায় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আসামী তুষার দাস @ মেথরের জামিন পাঁচ হাজার টাকা বন্ডে একজন বিজ্ঞ আইনজীবী ও একজন স্থানীয় ব্যক্তির জিম্মায় মঞ্জুর করা হল। অপরদিকে ভিকটিম সুষ্মিতা দেবনাথকে প্রতি ধার্য তারিখে আদালতে উপস্থিত থাকার শর্তে নিজ জিম্মায় মুক্তি দেয়া হল। উভয় পক্ষকে বন্ড দাখিল করতে বলা হল। যেহেতু আসামী, এজাহারকারী, ভিকটিম সকলের বয়সই আঠারো বছররে উর্ধ্বে কাজেই আলোচ্য মামলাটি শিশু আদালতের আর বিচার করার এখতয়িার না থাকায় মামলার বিষয়বস্তু ও ধারা বিবেচনায় মামলাটি বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, শরীয়তপুরে নথি প্রেরণ করা হোক।



ছ। অভিযোগকারী উক্ত আদেশ এর বিরুদ্ধে মহামান্য হাইর্কোটে আপীল দায়ের করেন। ০৭ আগস্ট ২০১৮ তারিখে উক্ত আপীল মামলায় মাননীয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহীম ও বিচারপতি মুস্তাফিজুর রহমান মহোদয়গণ আপীল মামলাটি গ্রহণ করে উক্ত আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। ফলশ্রুতিতে আসামীর জামিন আদেশ ও ভিকটিমের নিজ জিম্মায় জামিন আদেশও স্থগিত হয়ে যায়। এই আদেশ নিম্ন আদালতে জারি হওয়ার পর তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা করে।



জ। অপরদিকে ০৫ আগস্ট ২০১৮ তারিখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, শরীয়তপুর মামলার নথি গ্রহণর্পূবক শুনানীঅন্তে মামলার গুণাগুণ বিচারে আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খারিজ করে দেন। খারিজ করার ক্ষেত্রে আদালত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, যেহেতু মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী তারা দুজনই প্রাপ্ত বয়স্ক এবং স্বেচ্ছায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সেহেতু এই মামলা চলমান থাকার কোন কারণ নেই। আদেশের সংশ্লিষ্ট অংশ নিম্নে তুলে ধরা হলঃ

“As victim an adult female got marriage with adult accused willfully and as victim had not been abducted by the accused and as they both are husband and wife. So considering the above facts and circumstances, I found no prima facie case in framing charge or taking cognizance the above matter as an offence punishable under sections of Nari-O-Shishu Nirjatan Daman Ain...The accused be released and the case be dismissed.”

ঝ। এহেন পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ৩৭ ব্যাচের ছোট ভাই তারেক আব্দুল্লাহ এই মামলাটি আমার কাছে নিয়ে আসে এবং মামলার ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। ঘটনাটি চমকপ্রদ মনে হওয়ায় মামলাটি পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিই। আমি মামলার যাবতীয় নথিপত্র নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ জানাই। পরের দিন তারেক সকল নথিপত্র নিয়ে চেম্বারে আসে। ইতোমধ্যে সেকশন থেকে সংশ্লিষ্ট কাগজ পত্র তোলার জন্য আমি আমার ক্লার্ককে নির্দেশনা দেই। সকল কাগজপত্র পাওয়ার পর চেম্বারে বসে কয়েকজন মিলে আলোচনা করি। নথি পর্যালোচনায় দেখা যায় মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের মাধ্যমে তুষার দাসের জামিন স্থগিত হয়ে গেছে। অথচ মামলাটি তৎপূর্বেই নিম্ন আদালত খারিজ করে দেয়। ফলশ্রুতিতে আমি An application for vacating the order of stay দায়ের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। অতঃপর মামলাটি কার্যতালিকায় আসে। শুনানিঅন্তে মাননীয় আদালত সন্তুষ্ট হয়ে পূর্ববর্তী আদেশ সংশোধন করে উভয়ের জামিন বহাল রাখেন এবং মামলাটি শুনানির জন্য দিন তারিখ নির্ধারণ করেন। আদেশের সংশ্লিষ্ট অংশ নিম্নে তুলে ধরা হলঃ

Pending hearing of the Appeal let Tushar Das @ Raj... be enlarged on bail subject to furnishing bail bond to the satisfaction of the Chief Judicial Magistrate, Shariatpur.

ঞ। মাননীয় আদালত মৌখিকভাবে আমাকে বর্ণপ্রথা নিয়ে লিগ্যাল রিসার্স করতে আমাকে নির্দেশনা দেন। আমি আমার সহকারীদের নিয়ে সাধ্যমত চেষ্টা করি এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সকল আইন ও নজীর পর্যালোচনা করে ১৪৪ পাতার নথিপত্র আদালতে দাখিল করি। মাননীয় আদালত ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ও ১৬ জানুয়ারী ২০১৯ তারিখে মামলাটি শুনানি করেন এবং ১৬ জানুয়ারী ২০১৯ তারিখে মৌখিক রায় ঘোষণা করেন। উক্ত রায়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যাল, শরীয়তপুর-কে মামলাটি পরিচালনা করার নির্দেশ দেন এবং তুষার দাসের স্থায়ী জামিন মঞ্জুর করেন।



চ। আশ্চর্যের বিষয় যে, মামলা পরিচালনা করাকালে নিম্ন আদালত তাড়াহুড়া শুরু করেন। শুধু তাই নয়, মামলার বাদী পক্ষ বিভিন্ন সময় তুষার দাসকে দেখে নেওয়ার হুমকি প্রদান করে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার বাড়িতে পুলিশ প্রেরণ করে। সুষ্মিতা দেবনাথ অদিতিকে তার বাবার জিম্মায় নেওয়ার জন্য সকল প্রচেষ্টা চালায়। অধিকন্তু অদিতির বিরুদ্ধে সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু করেন। উল্লেখ্য যে, অদিতি তখন ৭ মাসের গর্ভবতী। এই খবর জানার পরপর আমি ক্রিমিনাল আপীল দায়ের করি। মাননীয় আদালতের সামনে মেনশন করে জরুরিয়ত বুঝাই। তিনি মামলাটি জরুরিভাবে শোনার সম্মতি জ্ঞাপন করেন। শুনানিঅন্তে আদালত সন্তুষ্ট হয়ে সার্চ ওয়ারেন্টের আদেশ স্থগিত করেন। আমি অতিদ্রুত স্থগিত আদেশ নিম্ন আদালতে প্রেরণের ব্যবস্থা করি। এই আদেশ পেয়ে নিম্ন আদালতের বিচারক অশালীন মন্তব্য করেন। তিনি মামলার ট্রায়াল দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এদিকে অদিতির শ্বশুর প্রতিদিন আমাকে সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে মুঠোফোনে অবহিত করতেন। মনে মনে একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নিজেই ট্রায়াল করতে যাব কিন্তু নিম্ন আদালতের আইনজীবীর সাথে কথা বলে তার যোগ্যতা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম। তথাপি নিম্ন আদালত ভিকটিমের জবানবন্দী ছাড়াই মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করেন। তিনি একই দিনে মামলার যুক্তি তর্ক শেষে ২৩ জুলাই ২০১৯ রায় প্রদান করেন। উক্ত রায়ে তিনি আসামী তুষার দাসকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ড প্রদান করেন। তুষারের বাবা তাৎক্ষণিক এই খবর মুঠোফোনে আমাকে অবহিত করেন। আমি একটু বিচলিত হয়ে গেলাম। এটি কিভাবে সম্ভব!আমি তাকে জরুরি ভিত্তিতে সার্টিফাইড কপি তুলে নিয়ে আসার জন্য বললাম। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন এবং আমাকে জানালেন যে, তাকে সার্টিফাইড কপি দেওয়া হচ্ছে না। আমি আবারো বললাম চেষ্টা করেন। তিনি আমাকে ৩০ জুলাই ২০১৯ সার্টিফাইড কপি প্রদান করেন। ওই দিন রাতেই আপীল এবং জামিন আবেদন প্রস্তুত করি। বেশ কিছু দলিলপত্রাদি হাতে লেখা থাকায় রাতেই টাইপের ব্যবস্থা করি। ৩১ জুলাই ২০১৯ সকাল ১০ মধ্যেই আপীল দায়ের করি। ১০.২৫ মিনিটে মেনশন লাইনের প্রথমে দাঁড়াই। ঠিক ১০.৩০ মিনিটে আদালত এজলাসে উঠেন। আমি অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বিষয়টি আদালতের সামনে তুলে ধরি। তিনি আমার কথা শুনে সহমর্মিতা দেখিয়ে পরের দিন ১ লা আগস্ট ২০১৯ তারিখে মামলাটি শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, ২রা আগস্ট থেকে উচ্চ আদালতের অবকাশকালীন ছুটি শুরু হওয়ার কথা ছিল। আমি আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে চলে আসি। ১ লা আগস্ট ২০১৯ নথিপত্র ও নজীরসমূহ নিয়ে আদালতে হাজির হই। সমস্ত ঘটনা খুলে বলি। আদালত নিজেও বিচলিত হন এবং তুষার দাসকে মামলা নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেন।



ছ। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, তুষারের স্ত্রী অদিতি সন্তান সম্ভবা ছিল। জুন মাসে তাদের কোলে একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। আপীল শুনানির দিন তুষারের স্ত্রী অদিতি তার সন্তানসহ আদালতে উপস্থিত ছিল। জামিনের সংবাদ পেয়ে সে অত্যন্ত খুশি হয় এবং সাংবাদিকদের সামনে কথা বলতে এনেক্স ভবনের সামনে আমার সাথে হাজির হয়। দেশের সকল ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্টিং মিডিয়া আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। ব্যক্তিগতভাবে অদিতির সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করে। তুষারের বাবা রনজিৎ দাস @ মেথর সার্বক্ষণিক আদালতে উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারের পর তারা ঢাকার লালবাগে আত্মীয়ের বাসায় রাত্রিযাপন করে। ৩ আগস্ট ২০১৯ তারিখে সে মুক্তি লাভ করে এবং জেলগেট থেকেই মুঠোফোনে আমার সাথে যোগাযোগ করে। ওই দিন চেম্বারের কাজ শেষে আমি পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে ব্যক্তিগত চিকিৎসকের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাই। এদিকে তুষার, তার স্ত্রী ও শিশু কন্যা আগে থেকেই স্কয়ার হাসপাতালের রিসিপশনে অপেক্ষা করতে থাকে। সাক্ষাৎ শেষে আমি এবং আমার স্ত্রী নিচ তলায় আসলে তারা দৌড়ে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে। ক্ষণিকেই আশে পাশের লোকজন জড় হয়ে যায়। ছবি তোলার জন্য তুষার বারবার বলতে থাকে। আমি রাজি হই এবং মুঠোফোনে কয়েকটি ছবি তুলি। এই ঘটনা আমাকে আজও নাড়া দেয়। এরও দু সপ্তাহ পর শুক্রবার মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারে মাছ কিনতে যাই। শরীয়তপুরের একজন মাছ বিক্রেতা আমাকে জড়িয়ে ধরেন আর বলতে থাকে “স্যার, আমার বাড়িও শরীয়তপুর। তুষারের বাড়ি আমার বাড়ির পাশে। আমি আপনাকে টিভিতে দেখছি। একটা বিরাট কাজ হইছে স্যার। এইটা কোন কথা হইল? এখনও উচু জাত আর নিচু জাতের ক্যাচাল আছে স্যার?” আমি তার কাছ থেকে শিং ও মাগুর মাছ কিনি। বাসায় গিয়ে এই গল্প পরিবারের সবাইকে শুনাই। সম্ভবত এখানেই একজন আইনজীবীর সার্থকতা নিহিত।

signature
20 September 2020